নিজস্ব প্রতিবেদক: লোহিত সাগরের নীল জলে দীর্ঘ ছয় মাসের শান্ত নিস্তব্ধতা যেন হঠাৎ করেই চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। রবিবার, হঠাৎই বাণিজ্যিক রুটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই পথের বুক চিরে বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা। ইরান-সমর্থিত ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা দাবি করেছে—তাদের রিমোট-নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরকবাহী নৌকা, রকেট ও ভারী অস্ত্রের হামলায় সাগরের অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছে ‘ম্যাজিক সিজ’ নামের একটি পণ্যবাহী জাহাজ।
এই হামলার মধ্য দিয়ে ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠল বিশ্ব অর্থনীতির রক্তনালির মতো গুরুত্বপূর্ণ এই সমুদ্রপথ।
যেভাবে ছিন্নভিন্ন হলো জাহাজের নিরাপত্তা
হুথিদের সামরিক মুখপাত্র জানান, লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী বাল্ক ক্যারিয়ার ‘ম্যাজিক সিজ’–কে আগে সতর্ক করে নাবিকদের নামতে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তারপরই চালানো হয় সমন্বিত হামলা—রকেট, বিস্ফোরক ও রিমোট-নিয়ন্ত্রিত বোট থেকে।
জাহাজটি ছিল চীন থেকে তুরস্কগামী, বোঝাই ছিল লোহা ও সার।
হামলার পর জাহাজে পানি ঢুকতে থাকে, এবং একপর্যায়ে তা তলিয়ে যায় বলে দাবি করে হুথিরা। তবে এখনও এ ঘটনার সত্যতা স্বাধীনভাবে যাচাই করা যায়নি।
গ্রিক কোম্পানির বক্তব্য: "ডুবে যাওয়ার প্রমাণ নেই"
জাহাজটির গ্রিক পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ‘স্টেম শিপিং’ এই হামলার সত্যতা মেনে নিলেও, তারা বলেছে—জাহাজটি আদৌ ডুবেছে কি না, তা নিশ্চিত নয়।
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মাইকেল বোডুরোগ্লু বলেন,
“হামলার পর জাহাজে পানি ঢুকতে শুরু করে। আমরা বিপদ আঁচ করেই নাবিকদের সরে যেতে বলি। পাশে থাকা একটি বাণিজ্যিক জাহাজ তাদের উদ্ধার করে এবং নিরাপদে জিবুতিতে পৌঁছে দেয়।”
এ ঘটনার পটভূমি জুড়ে আছে গাজা সংকট, ইরান-ইসরায়েল সংঘাত এবং যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন—যা একে শুধুমাত্র একটি বিচ্ছিন্ন সামুদ্রিক হামলা নয়, বরং এক জটিল ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ করে তোলে।
অস্থির জলপথ: সাগরের উপর ভেসে থাকা রাজনীতি
২০২৩ সালের শেষ প্রান্ত থেকে হুথিদের ধারাবাহিক হামলায় রীতিমতো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল লোহিত সাগর। ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যকার এই ব্যস্ত রুটে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নেমে আসে সংকট।
তবে চলতি বছরের এপ্রিলের পর থেকে পরিস্থিতি ছিল শান্ত। হুথি-যুক্তরাষ্ট্র সমঝোতায় এসেছিল সাময়িক বিরতি।
কিন্তু সেই বিরতি যে ক্ষণস্থায়ী হবে—তার ইঙ্গিত দিয়েছিল গত জুনেই। হুথিদের কণ্ঠে তখন শোনা গিয়েছিল কড়া হুঁশিয়ারি—
“ইসরায়েল যদি ইরানে হামলায় যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে পায়, তবে লোহিত সাগরে মার্কিন জাহাজও নিরাপদ নয়।”
আর সেই হুঁশিয়ারির বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে রবিবারের ঘটনায়।
শান্তির চুক্তি, যুদ্ধের ঝড়
গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুথিদের সঙ্গে এক সমঝোতার ঘোষণা দেন। ওমানের মধ্যস্থতায় চুক্তিতে উভয় পক্ষ একে অপরকে লক্ষ্যবস্তু না করার অঙ্গীকার করেছিল।
এই সমঝোতা ছিল আশার আলো, বিশেষত লোহিত সাগরের মতো স্পর্শকাতর রুটের নিরাপত্তার জন্য।
কিন্তু বিশ্ব কূটনীতির টানাপোড়েনে সেই আলো যেন ম্লান হয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্র যখন সম্প্রতি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালায়, তখন থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের বাতাসে বারুদের গন্ধ ফিরে আসে।
ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের ছায়া
হুথিরা একাধিকবার বলেছে—তারা ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এই হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।
২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত তারা শতাধিক সামুদ্রিক হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেছে।
এই ঘোষণায় স্পষ্ট যে, সাগরের বুকে এই সংঘাত আর শুধুই একটি জাহাজের গল্প নয়, বরং তা একটি জাতির জন্য সহানুভূতির, আরেক জাতির প্রতি ঘৃণার, এবং বহু রাষ্ট্রের ভূরাজনীতির সংঘর্ষের বহিঃপ্রকাশ।
বিশ্ব অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই হামলা সামান্য ঘটনা নয়। এটি বিশ্বব্যাপী জ্বালানি পরিবহন, খাদ্য সরবরাহ ও শিল্প কাঁচামাল পরিবহনে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
লোহিত সাগর, বাব আল-মান্দাব প্রণালী এবং সুয়েজ খাল এই তিন পথ মিলে যে গুরুত্বপূর্ণ ট্রেড করিডর তৈরি করে—তা এখন নতুন করে অনিশ্চয়তার মুখে।
শান্ত জলরাশিতে এখন উত্তাল ঢেউ
রবিবারের ঘটনার মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হলো—শান্ত সাগরও চুপচাপ থাকে না সবসময়। ভূরাজনীতি, যুদ্ধ আর প্রতিশোধের তীব্র আবেগ কখন কীভাবে আছড়ে পড়ে, তা অনুমান করা কঠিন।
‘ম্যাজিক সিজ’ হয়তো ডুবে গেছে, হয়তো নয়—কিন্তু নিশ্চিতভাবে ডুবে গেছে লোহিত সাগরের সেই ক্ষণিকের নিস্তব্ধতা।
এম,আর,এ/
নিউজটি আপডেট করেছেন : Jatiyo Potrika
হুথিদের রকেট হামলায় লোহিত সাগরে জাহাজ ডুবির ঘটনা ঘটেছে
- আপলোড সময় : ০৭-০৭-২০২৫ ১১:৫৯:০৫ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৭-০৭-২০২৫ ১১:৫৯:০৫ অপরাহ্ন

সর্বশেষ সংবাদ